দেলোয়ার হোসেন জাকির।।
দুর্নীতিতে নিমজ্জিত কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তর। যেখানে টাকায় মিলে সকল প্রকার ছাড়পত্র। কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সীমাহিন হয়রানির শিকার কুমিল্লায় এ দফতর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িতরা। বসচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ উৎপাদনমুখী ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলো। ঘুষ দিলে অবৈধ প্রতিষ্ঠান ছাড়পত্র পেয়ে যায়, আর ঘুষ নাদিলে বৈধরা হয় হয়রানির শিকার।
‘কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তর’ যেখানে অবৈধ ইটভাটার চুল্লির তাপের চেয়ে ঘুষের টাকার উত্তাপ বেশি। জেলার পরিবেশ দুষণ থেকে শুরু করে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্তদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব যে সংস্থার হাতে সেই দফতরের কার্যক্রমে এখন ক্ষুব্ধ সচেতন মহল। পাহাড় কাটা, জলাশয় ও পুকুর ভরাট ও অবৈধ ইট ভাটার দাপটে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হলেও এ দফতরের উপ-পরিচালক শওকত আরা কলিসহ অফিসের অন্যানদের লাগামহীন ঘুষ বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে এ অফিস যেন ঘুষের হাট।
এ দপ্তরে টাকা দিলে অবৈধ ইটভাটা হয়ে যায় বৈধ আর টাকা না পেলে বৈধ ইটভাটার উপরও নেমে আসে জরিমানার খড়ক। নতুন ইটভাটা স্থাপনে ছাড়পত্র নিতে লাগে ৫ লাখ টাকা আর ইটভাটা বার্ষিক নবায়নে করতে উৎকোচ ফিস দিতে হয় ১ লাখ টাকা। শুধু ইটভাটাই নয়, রাইস মিল, স’মিল, পোল্ট্রি ফার্ম কিংবা ক্ষুদ্র ইন্ড্রাস্ট্রির কোনটিতেই টাকা ছাড়া মিলে না ছাড়পত্র। এমনকি বহুতল ভবন নির্মাণে ছাড়পত্রের জন্য দিতে হয় ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা আর স’মিলের ছাড়পত্রের জন্য ৫০ হাজার টাকা। অবৈধ ইটভাটা,রাইসমিল সহ ক্ষুদ্র কারখানা থেকে উঠানো হচ্ছে মাসোহারা। অনুসন্ধানে অত্র অফিসের আরও ভয়াবহ দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য বেড়িয়ে এসেছে।
অপরদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের উদাসীনার কারণে দখলে-দূষণে কুমিল্লার প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা বিরাজ করছে। কুমিল্লার গোমতী নদী ঘিরে চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। কোথাও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন হচ্ছে। কোথাও নদীর বাঁধের ভেতরের ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। অপরদিকে ময়নামতি -লালমাই পাহাড় কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। কেউ বানাচ্ছেন পার্ক আবার কেউ বানাচ্ছেন পিকনিক স্পট, রিসোর্স সেন্টার কেউবা আবার বাংলো বাড়ি। কুমিল্লায় যে পাহাড় নিধন চলছে তা হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তারা অন্ধের ভূমিকায় রয়েছেন। কোন অভিযোগকে পাত্তা দিচ্ছেন না। এতে হুমকির মুখে পড়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দুুষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। এসব বিষয় দেখার দায়িত্ব যে সংস্থার হাতে ন্যস্ত সেই পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রম অনেকটা দায়সাড়া। মাঝে মধ্যে কিছু অভিযান দেখানো হলেও বছরের অধিকাংশ সময়ই এ দপ্তরে চলে প্রকাশ্যে ঘুষের লেনদেন। প্রসঙ্গ কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়। এ অফিসটি হাউজিং এস্টেট এলাকায় ভাড়া বাড়িতে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে জেলা সদরের জজকোর্ট এলাকায় নিজস্ব ভবনে চলছে কার্যক্রম। এভবনকে ঘিরে উপ-পরিচালক শওকত আরা কলির নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে ঘুষের এ স্বর্গরাজ্য।
অটোরাইস মিল ছাড়পত্রে ৫ লাখ টাকার বানিজ্য :
সম্প্রতি সময়ে বুড়িচংয়ে জনবসতিপূর্ণ স্থানে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে একটি অটোরাইস মিলের ছাড়পত্র প্রদান করে বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে কুমিল্লা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর। কুমিল্লা-মীরপুর সড়কের বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের গাজীপুর মৌজাস্থিত খাড়াতাইয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ও মর্ডান ইসলামিয়া স্কুল এন্ড টেকনিক্যাল কলেজের পাশে জনবহুল আবাসিক এলাকায় অটো রাইছ মেইল গড়ার উদ্যেগ নেন অতি গোপনে। চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে বুড়িচং উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ কামাল হোসেন ‘মেসার্স জাহানারা অটো রাইছমিল’ স্থাপনের লক্ষে কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরে একটি ছাড়পত্রের আবেদন জমা দেয়। আবেদনের এক মাসের মধ্যে পার্শ্ববর্তী লোকজনের সাথে কথা না বলেই ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ছাড়পত্র দিয়ে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। জুন মাসের প্রথম দিকে স্থাপনা নির্মাণের কাজ আরম্ভ করলে বিষয়টি স্থানীয়দের নজরে আসে।
আবাসিক এলাকা ও একশত গজের মধ্যে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার পরও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে এলাকাবাসী। কারখানাটি অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য ১২৭ জন গ্রামবাসীর স্বাক্ষরিত অভিযোগ পত্র বিভিন্ন দপ্তরে দায়ের করেন।
জানা যায়, মিলটি অন্যত্র স্থাপন করার জন্য প্রথমে গ্রামবাসী মিল মালিকের বরাবরে লিখিত ভাবে অনুরোধ জানান। মিল মালিক বিষয়টি কর্নপাত না কারায় গ্রামবাসীর পক্ষে মিল সংলগ্ন বাড়ীর হাজী সুরুজ মিয়া খন্দকারের ছেলে মোঃ জাকির হোসেন খন্দকার বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেন। তাঁর মধ্যে কুমিল্লা – ৫ আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, পরিবেশ ও জলবায়ূ পরিবর্তন মন্ত্রনালয়ের সচিব, কুমিল্লা জেলা প্রশাসক, কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক, বুড়িচং উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), থানা অফিসার ইনচার্জ ও স্থানীয় প্রেসক্লাবে অভিযোগের অনুলিপি প্রদান করেন।
তৎকালীন সময় কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শওকত আরা কলি সাংবাদিকদের জানান, মিলটির ছাড়পত্রের জন্য আবেদনের পর ইন্সপেক্টর নজরুল ইসলাম ইসলাম তদন্ত করে রিপোর্ট জামা দেয়ার পর প্রাথমিক পর্যায়ে ছাড়পত্র দেয়া হয়। পরবর্তীতে অভিযোগ আসার পর আমি নিজে পরিদর্শন করে বুঝতে পারি, প্রথম রিপোর্টে কিছু ভূল ছিলো। তাই আমি পুনরায় উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের বরাবরে নতুন করে সংশোধিত রিপোর্ট পেশ করেছি।
মুলত: মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে ওই রাইচ মিলের অনুমোদন দেওয়া হয়। এলাকাবাসীর বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দায়ের ও তীব্র প্রতিবাদের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লা ছাড়পত্র বাবদ দেওয়া ঘুষের টাকা এখনো ফেরত পায়নি মিলের মালিক। সময় সুযোগ বুঝে ছাড়পত্র দিবে এমন আশ্বাসে দিয়ে যাচ্ছেন তাকে।
এদিকে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের জেলার রামপুর পারুয়ার এলাকায় গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি রাইচ মিল। মিলের বাধ্যতামূলক ওয়াটার টিটমেন্ট প্ল্যান্ট থাকার নিয়ম থাকলেও অনেক অটোরাইচ মিলেই তা নেই। এইসব মিলগুলো ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। হুমকীর মুখে ওই এলাকার চাষাবাদ। কমছে আবাদযোগ্য জমির উবর্রতা।
অটোরাইচ মিলের রাসায়নিক জনস্বাস্থের উপরও বিরুপ প্রভাব পড়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ পরিবেশ অধিদপ্তর ওই রাইস মিলমালিকদের কাছ থেকে মাসিক মাসোহারা নিয়ে আসছেন। মাসোহারার বিনিময়ে পরিবেশ অধিদপ্তর নিস্ক্রিয় থাকায় থাকায় কুমিল্লা অটোরাইচ মিলের মালিকরা নির্বিঘ্নে মিলের দূষিত বজর্য বিভিন্ন স্থানে ফেলছে।
টাকায় মিলে স’মিল, পোল্ট্রি ফার্মের ছাড়পত্র :
টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায় স’মিলের ছাড়পত্র। টাকার কাছে হয় নিয়ম-নীতি বিপন্ন। হয়না সরজমিনে তদন্ত। নতুন স’মিল স্থাপনের জন্য পরিবেশের ছাড়পত্র নিতে ঘুষ দিতে হয় ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। আর প্রতি বছরে নবায়ন করতে লাগে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। আবদুর রশিদ, জহিরুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম, মোক্তার হোসেন সহ কয়েকজন কাঠ ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। জেলার সৈয়দপুর এলাকার পোল্ট্রি ফার্ম ব্যবসায়ী ফরহাদ হোসেন জানান, পোল্ট্রি ফার্ম স্থাপনে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় কুমিল্লা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরকে।
দুই দপ্তরে ইটভাটার ছাড়পত্রের বিশাল ফাড়াক! নেপথ্যে বানিজ্য :
কুমিল্লায় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিলেও অর্ধেকেরও বেশী ইটভাটার নেই ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র। আবার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ে এক নাম এবং পরিবেশ অধিদপ্তরে রয়েছে আরেক নাম। পরিবেশ অধিদপ্তরের যোগসাজসে অনিয়মের মাধ্যমে হয়েছে মালিকানা বদলও। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ৩১৪টি ইটভাটার ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৫টি ইটভাটা নবায়ন করেছে এবং ১২৯টি ইটভাটা নবায়ন করেনি। সিটি করপোরেশন এলাকায় অবৈধ ইটভাটা রয়েছে ৬টি। অপরদিকে ফায়ার সার্ভিস থেকে ছাড়পত্র নিয়েছে ১৫৩টি। এর মধ্যে ৭৬টি নবায়ন করলেও ৭৭টি এখনো নবায়ন করেনি। দুই দপ্তরে ছাড়পত্র গ্রহণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশাল পার্থক্য। অনুসন্ধানে জানা যায়, ফায়ার সার্ভিস অনুমোদন না দিলেও মোটা অংকের বিনিময়ে কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র নিয়ে এসব ইটভাটা চলছে। ইটভাটা মালিকদের এই মাসোহারার ভাগ চলে যাচ্ছে চট্রগ্রাম পরিচালকের অফিসে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গেল বছরের ২৫ জানুয়ারি কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নারায়নপুর এলাকায় কাজী এন্ড কোং নামে একটি ইটভাটায় কয়লা বোঝাই ট্রাক উল্টে ঘুমন্ত ১৩ জন শ্রমিক নিহত হন। এ ঘটনাটি আলোচিত হয় দেশজুড়ে। দুর্ঘটনার পর পুরো ব্রিক ফিল্ড আব্দুর রাজ্জাক মজুমদার ক্রয় করে নেন। গত অর্থবছরে মালিকানা পরিবর্তন হলেও চলতি অর্থবছরে কাজী এন্ড কোং নামে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে ছাড়পত্র গ্রহণ করা হয়। কিন্তু অবৈধ উপায়ে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নাম পরিবর্তন করে মজুমদার ব্রিকস্ নামে ছাড়পত্র নেয়া হয়। এসব বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক।
জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ইটভাটা সংক্রান্ত আইন হয়েছে বাংলাদেশে। আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, কোথায় ইটভাটা স্থাপন করা যাবে আর কোথায় যাবে না। যত্রতত্র ইটভাটার কারণে ফসলি জমি আর জনস্বাস্থ্য দুটোরই বারোটা বেজে চলেছে। বায়ুদূষণের অন্যতম কারণও নিয়মনীতি না মেনে ইটভাটা স্থাপন। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন হয়েছে ২০১৩ সালে। আইনের সারমর্ম হলো পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। কৃষিজমি, পাহাড় বা টিলা কেটে মাটি ব্যবহার যেমন করা যাবে না। কিন্তু কুমিল্লায় বান্তবে পরিস্থিতি ভিন্ন। পরিবেশ অধিদপ্তরকে মোটা অংকের বিনিময়ে কুমিল্লায় কৃষিজমি ও লোকালয়ের পাশেই হচ্ছে ইটভাটা স্থাপন। অবৈধ এসব ইটভাটার কারণে স্বাস্থ্যঝুকি ও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান সিভিল র্সাজন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান।
লালমাই পাহাড় কেটে সাবাড়
অমূল্য প্রত্নসম্পদে ভরা কুমিল্লার ময়নামতি-লালমাই পাহাড়। সুউচ্চ টিলাজুড়ে বৃক্ষরাজি ও জীববৈচিত্রের সমাহার ছিল একসময়। আইনকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে লালমাই পাহাড় কেটে সাবাড় করা হচ্ছে, প্রতিদিন শত শত গাড়ি পাহারের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে, মাটি ব্যবসায়ীদের দাবি কুমিল্লা পরিবেশ াধিদপ্তরকে ম্যানেজ করেই এ কাজ করছে তানা। গড়ে উঠছে পার্ক, পিকনিং স্পট , বাংলো বাড়ি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেপথ্যে গড়ে উঠছে বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ক্রমেই ময়নামতি-লালমাই পাহাড়-টিলা রূপ নিচ্ছে সমতল ভূমিতে। অবাধে মাটি কাটার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গহিন বনও। পরিবেশ অধিদপ্তরকে ম্যানেজ করে দেদার চলছে এই প্রকৃতি নিধনযজ্ঞ।
স্থানীয়রা জানান, আশির দশক থেকে লালমাই পাহাড়ের সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর ও বারপাড়া ইউনিয়নে মাটি কাটা শুরু হয়। শত শত টিলা গত ৪০ বছরে কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করা হয়। কোটবাড়ী থেকে চন্ডীমুড়া পর্যন্ত প্রায় ২২ কিলোমিটার এলাকার বিস্তীর্ণ লালমাই পাহাড়ের বিভিন্ন অংশের মাটি অবাধে বিক্রি করা হয়। এর আগে লালমাই পাহাড়ের রাজারখলা, বড় ধর্মপুর, রতনপুর, চৌধুরীখলা, সালমানপুর ও ধনমূড়ার উত্তর অংশের পাহাড় কাটা হয়।
সদর উপজেলার কালিরবাজার এলাকার বাসিন্দা সোলেমান খান, মোবারক হোসেন, তাজুল ইসলাম জানান, জাঙ্গালিয়া দক্ষিন কাচার গ্রামের মৃত হাফেজ আহাম্মে এর পুত্র আবদুল মালেক প্রায় দেড়যুগ ধরে ওই এলাকায় পাহাড় কেটে মাটি ব্যবসা চালিয়ে আসছে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে বেশ কয়েকবার অভিযোগ দিলেও তাদের টনক নড়ছে না। ৪/৫ বছর আগে একবার মামলা হলেও সে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে ১৫ দিন পরই আবার মাটি ব্যবসা শুরু করে। স্থানীয়রা জানান, স্থানীয় নাজিরাবাজার পুলিশ ফাঁড়ি ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে মাসিক মসোহারা বিনিময়ে মালেক পাহাড় কেটে অবাধে মাটি বানিজ্য চালাচ্ছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরকে ম্যানেজ করেই গোমতীতে চলছে ধ্বংসযজ্ঞ :
পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লা দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলার আদর্শ সদর উপজেলার কটকবাজার থেকে দাউদকান্দি উপজেলার কলাতিয়া পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ ওই নদী। নদীর উভয় তীরে ১৩৫ কিলোমিটার শহররক্ষা বাঁধ রয়েছে। নব্বইয়ের দশক থেকে নদী থেকে বালু উত্তোলন শুরু হয়। বর্তমানে গোমতীতে বালুর পরিমার কমে যাওয়ায় নদীর চরের কৃষি জমি কেটে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে জেলার সদর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে গোমতী নদী অর্ধ-শত স্পটে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সম্প্রতি গোমতী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, নদীর পাড়ের মানুষের কৃষিজমি কেটে নদীতে মাটি ফেলা হচ্ছে। এরপর ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু ও মাটি মিশ্রিত পানি অন্যত্র ফেলা হচ্ছে। এই অংশে অসংখ্য ড্রেজার মেশিন রয়েছে। নদীর উত্তর পাড়ে বাঁধ কেটে ট্রাক্টর মাটি নিয়ে ওঠানামা করছে। পরিবেশবিরোধী এ কাজের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না পরিবেশ অধিদপ্তর। কথিত আছে প্রতিটি পয়েন্ট থেকে পরিবেশ অধিদপ্তর মাসিক মসোহারা নিয়ে আসছে। এ টাকার ভাগ যাচ্ছে চট্রগ্রাম পরিচালকের অফিসেও।
এবিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লা উপপরিচালক শওকত আরা কলি সংবাদ মাধ্যেমকে বলেন, বাঁধের ওপরের সড়কের পাশে পরিবেশ অধিদপ্তর সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড আছে। সেখানে সাজার কথা লেখা আছে। তাঁরা পরিবেশ রক্ষার চেষ্টা করছেন।
জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, প্রশাসন যখনই অভিযোগ পেয়েছে, তখনই ব্যবস্থা নিচ্ছে। তাঁরা জরিমানা ও ড্রেজার মেশিন জব্দ করেছেন। এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
ইপিজেডের বজের্য মরছে মাছ, কমছে ফসল:
প্রায় ৫ বছর আগে কুমিল্লা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রীয় তরল বজর্য পরিশোধনাগার স্থাপন করা হয়। তখন আশপাশের মানুষ ভেবেছিল, তাদের জমিতে তরল বজর্য আর ঢুকবে না। নদীনালা ও খালবিলের মাছ এবং জলজ উদ্ভিদ রক্ষা পাবে। কিন্তু তরল বজর্য চুইয়ে পানিতে মিশছে। এ কারণে জলাশয়ের মাছ মরে যাচ্ছে। জমিতে ফসলের উৎপাদন কম হচ্ছে। এনিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর উদাসীন ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৭ অনুযায়ী, এর তরল বজর্য নির্গমণ মানমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। কুমিল্লা ইপিজেডের কারখানাগুলো কেন্দ্রীয়ভাবেই বজর্য পরিশোধনের সুযোগ পাচ্ছে। এরপরও তরল বজর্য দক্ষিণ কুমিল্লার বিভিন্ন ফসলি জমি, নদীনালা, পুকুর, বিল ও জলাশয়ে চুইয়ে যাচ্ছে। এ কারণে জমি নষ্ট হয়ে ফসল কম হচ্ছে। নানা প্রজাতির দেশি মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো ডাকাতিয়া নদীর পানির রং কালো দেখাচ্ছে। কুমিল্লা-চাঁদপুর সড়কের বিজয়পুর পাকা সেতুর নিচেও কালো পানি। বামিশা, দিঘিরপাড় কলেজের আশপাশের কৃষিজমিতেও কালো পানি দেখা গেছে। লালমাই উপজেলার দত্তপুর এলাকার খালেও একই অবস্থা। লাকসামের ডাকাতিয়া নদীর অংশেও একই অবস্থা। কুমিল্লা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজের পেছনের জলাশয় ও বিলের পানি কালো। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষন করা হলেও তা অজ্ঞাত কারণে আমলে নিচ্ছে না।
ভরাট হচ্ছে একের পর এক জলাশয়-পুকুর :
এককালের কুমিল্লাকে ট্যাঙ্কের শহর (প্রাচীনকাল থেকে কুমিল্লায় প্রচুর পুকুর ও দিঘি থাকায় একে ট্যাঙ্কের শহর বলা হয়) বলা হলেও সেই ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিরবতায় কুমিল্লায় একের পর এক পুকুর দিঘী ও জলাধার ভরাটের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি নগরীর জর্জকোট এলাকায় বর্তমান জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের পূর্ব সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে থাকা জলাশয়টি কৌশলে ভরাট করা হচেছ ময়লা-আবর্জনা ফেলে। তা সচেতন মহলের চোখে পড়লেও চোখ পড়ছে না পরিবেশ অধিদপ্তরের।
সম্প্রতি নগরীতে ভরাট করা হচ্ছে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো একটি পুকুর। স্থানীয়দের কাছে পুকুরটি কাজীবাড়ির পুকুর বা কাজী পুকুর নামে পরিচিত। এটির অবস্থান নগরীর ২০নং ওয়ার্ডের কাজীপাড়া পশ্চিমপাড়ায়। ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ শতকের পুকুরটির অর্ধেক ভরাট হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব সামছুল হক বলেন, পুকুরটি প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো। পুকুরের জায়গা নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে বিরোধ ছিল। এখন বিরোধ মিটিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ম্যানেজ করে এক পক্ষ পুকুরটির অর্ধেক ভরাট করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লার উপপরিচালক শওকত আরা কলি এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, পুকুরটি ভরাট করা নিয়ে একটি অভিযোগ পেয়েছি। এরপর ভরাটকারীদের ফোন করে বলেছি তা বন্ধ করতে। ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। স্থানীয়রা জানান, বাস্তবে এ বিষয়ে কার্যকর কোন ব্যবস্থা চোখে পড়েনি।
কাজিপাড়ার ওই পুকুরের মতোই কুমিল্লায় একের পর এক পুকুর ভরাট হচ্ছে। পুকুর ভরাটের বিষয়ে অভিযোগ দিলেই পরিবেশ অধিদপ্তর নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মিশন নিয়ে। ভুক্তভোগী হাসান খান সহ কয়েকজন জানান, অভিযোগ দিলে তারা একটি নোটিশ করে ফাঁদ ফেলে মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের লাগামহীন ঘুষ বানিজ্যে ক্ষুব্দ কুমিল্লার সচেতন মহল।
এদিকে ঘুষ লেনদেনসহ নানা অভিযোগ বিষয়ে বক্তব্য নিতে এ প্রতিবেদক রবিবার দিনভর চেষ্টা করেও কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শওকত আরা কলির বক্তব্য নেওয়া যায়নি। অফিসে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয়ে খোঁজ নিলে অফিস স্টাফরা জানান, ম্যাডাম বাহিরে ভিজিটে গেছেন। মোবাইল নম্বরে (০১৭৩৩০৬৩০৪৮) বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।